বিশ্বের শীর্ষ ঘনবসতিপূর্ণ মেগাসিটি রাজধানী ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর। ঢাকা মাঝেমধ্যেই বায়ুদূষণে সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে; কিন্তু গতকাল দূষণের মান বা স্কোর সাম্প্রতিক সময়ের সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। পৃথিবীর ১২৫টি নগরীর মধ্যে বায়ুদূষণে গতকাল সকালে শীর্ষে উঠে এসেছে ঢাকা। সকাল সোয়া ৮টার দিকে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুযায়ী মানসূচকে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ৪৯৩। বায়ুর এই মানকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বায়ুর মান ৩০০ পার হলেই তাকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বলা হয়। বিশ্বের সর্বোচ্চ বিষাক্ত বায়ুতে নিঃশ্বাস নিয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে নগরবাসী। স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারির তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উপাদান হলো বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২.৫ এর উপস্থিতি। গতকাল ঢাকার বাতাসে এর উপস্থিতি ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানমাত্রার চেয়ে ৬৪ গুণ বেশি। এমন বেশি মাত্রার দূষণ শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদরোগ এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
বায়ুদূষণের যে অবস্থা, তা থেকে রক্ষা পেতে আইকিউএয়ারের পরামর্শ, ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। খোলা স্থানে ব্যায়াম করা যাবে না। ঘরের জানালা বন্ধ রাখতে হবে। বায়ুদূষণের ফলে নগরবাসীর প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। বায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই দূষণ কমাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এটা কেবল মানব শরীর বা পরিবেশ নয়, মানুষের গড় আয়ুতেও আঘাত করছে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, ‘গতকাল বায়ুর যে মান ছিল, তা সত্যিই ভয়ানক। টানা তিন দিন ধরে তিন ঘণ্টা করে যদি স্কোর ৩০০ এর বেশি থাকে তবে সেই এলাকায় স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়। এখন ঢাকার বায়ুর যে মান, তাতে মানুষকে সচেতন করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের উচিত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এবং সেইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সচেতনতা তৈরিতে বার্তা দেওয়া।’ ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, গত ডিসেম্বরে বায়ুর গড় মান ছিল ২৮৮। ২০১৬ থেকে এত খারাপ কখনোই হয়নি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বায়ুর মান ছিল ১৯৫। গত ৯ বছরে ডিসেম্বর মাসে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২১৯.৫৪। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এই মান ৩১ ভাগের বেশি বেড়ে গেছে। আর ২০২৩-এর তুলনায় বেড়েছে ২৬ ভাগের বেশি। গত ডিসেম্বর মাসের একটি দিনও নির্মল বায়ু পায়নি রাজধানীবাসী। দূষণসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের এক জরিপে দেখা গেছে, ডিসেম্বর মাসে যত বায়ুদূষণ ছিল, তা গত ৯ বছরে সর্বোচ্চ। গতকাল বিশ্বে বায়ুদূষণে ৩৫৮ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইরাকের বাগদাদ। এরপর ভিয়েতনামের হ্যানয়ের স্কোর ২১৯। দেশের অন্য বিভাগীয় শহরের মধ্যে চট্টগ্রামের বায়ুর মান ১২৬, রাজশাহীতে ১৬৯ আর খুলনায় ১৭৩।
রাজধানী ও আশপাশের তিনটি সর্বোচ্চ দূষিত এলাকার মধ্যে আছে গুলশান লেক পার্ক (৭৬৯), গুলশান-২-এর রব ভবন (৭২৮) ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এলাকা (৭০৬)। পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলা। বাংলাদেশে একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি ধরনকে ভিত্তি করে কণা পদার্থ (পিএম১০ এবং পিএম২.৫), কার্বন মনোঅক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড এবং ওজোন। জাতিসংঘের দেওয়া একটি তথ্য থেকে জানা যায়, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে অন্তত ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও) জানায়, শুধু বাংলাদেশেই নয়, বায়ুদূষণ বিশ্বব্যাপী মৃত্যু ও অক্ষমতার শীর্ষ ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে একটি। দূষিত বাতাসে দীর্ঘদিন শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের ফলে হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ এবং ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় বলে বিভিন্ন গবেষণায় স্বীকৃত হয়েছে।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস প্রফেসর আইনুন নিশাত বলেন, নির্মাণাধীন স্থাপনার ধূলিকণা, আর্থ ফাইলিং এবং রাস্তা, ওভারলোডেড মোটরযানের কালো ধোঁয়া এবং ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থিত ইট ভাটাগুলো শীতকালে শহরের বাতাসের মান খারাপ করার জন্য অনেকাংশেই দায়ী। সুতরাং, সমস্ত ইটভাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আধুনিকীকরণ করা উচিত।স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণা বলছে, কোনো কিছু পোড়ানোর ফলে যে বায়ুদূষণ হয় তার উৎস ঢাকা শহরে দুটি। এর একটি হলো যানবাহন, আর অন্যটি হলো বর্জ্য পোড়ানো। ৬০ শতাংশ বায়ুদূষণ হয় রাতের বেলা। ঢাকার ১০০টি স্থানে বর্জ্য পোড়ানো হয়। যেখানে যেখানে বর্জ্য পোড়ানো হয় সেখানে বায়ুদূষণ বেশি হয়। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ, নিউ মার্কেটের ডাম্পিং এলাকায় প্রচুর বর্জ্য পোড়ানো হয়। ঢাকাতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ গাড়ি চলাচল করে। এই গাড়ি থেকেও দূষণ ছড়ায়। রাতে বায়ুদূষণ বাড়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, রাতে বায়ুর চাপ বেড়ে যায়। উপর থেকে বায়ু নিচের দিকে চাপ দেয়। রাতে তাপমাত্রা কমে যায় এবং কুয়াশা পড়ে, এ কারণে আকাশ ভেজা ভেজা থাকে। আবার দেখা যায় দিনের বেলায় বায়ুপ্রবাহের গতি বেশি থাকে; রাতে কম থাকে। এসব কারণে ধুলাবালি নিচের দিকে থাকে। বায়ুদূষণ বাড়ে। এ ছাড়া আন্তঃনগরীয় বাসগুলো রাতে প্রচণ্ড গতিতে চলাচল করে। রাতে সংস্কারের কাজও হয়। রাতে দ্রুত গতিতে যান চলাচলের কারণে ধুলা উড়তে থাকে। নির্মাণকাজের জন্য ব্যবহৃত ইট, বালু, সিমেন্ট রাতে পরিবহনের মাধ্যমে স্থানান্তর হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ট্রাকে মাটি, সিমেন্ট, ইট ঢেকে পরিবহন করার কথা থাকলেও তা হয় না। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিতে ঢাকায় জরুরি অবস্থা জারির পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেন, বায়ুমান সূচক ২১৯.৫২ উঠলে তা জরুরি অবস্থা জারির পর্যায়ে যায় সেখানে ঢাকার বায়ুর মান ৪৯৩। এমন পরিস্থিতি টানা তিন দিন থাকলে বিশ্বের যে কোনো দেশ স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করে।
সাধারণত বৃষ্টির মৌসুমে বায়ুদূষণ কমে যায় আর বাড়ে কুয়াশামোড়া শীতকালে। শীতে কুয়াশার কারণে বাতাসে জলীয় বাষ্প বেড়ে যায়, আর তাতে জমা হয় মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা। এবার শীত আগেভাগে শুরু হওয়ায় বস্তুকণা বাতাসে দ্রুত জমা হতে শুরু করেছে। সুতরাং এই সময়ে প্রতিটি নাগরিকের সতর্ক থাকা জরুরি।